ফিরে দেখা - এহসান আল মিরাজ
রফিক চাচা চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর মিটি মিটি হাসছেন। সামনে বেঞ্চে বসে করিম শেখ আর মনজু দাবা খেলছে। দুজনেই সমান গতিতে ভুলভাল সব চাল চালছে। রফিক চাচা বললেন,
চাচা-এই শিখলি দাবা?
মনজু-চাচা মাথায় খেলছে না একদম।
চাচা-আরে বড়েটা এগিয়ে ওর নৌকোটা কেটে দে না।
করিম শেখ-এটা কিরকম হলো চাচা। আপনি মাঝখান থেকে এসে ওকে বলে দিলেন। এটা ঠিক হলো? খেলবো না আমি।
চাচা হাত এগিয়ে নৌকোটা পিছিয়ে দিয়ে বললেন,
চাচা-এই নে, তোরও একটা চাল আমি দিয়ে দিলাম। হলো এবার?
কোথা থেকে হঠাৎ নুড়ি এসে হাজির।
নুড়ি-অ, দাদা। টাকা দে।
চাচা-এই নুড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াস না। দুপুরে আজ আমার ওখানটায় খাবি। ভুলে যাস না যেন।
রফিক চাচা ঘাটের দিকে যেতে লাগলেন। মাঝিকে দিয়ে টুকটাক বাজারপাতি এনে রাখতে হবে। পথিমধ্যে দিব্য এর ফোনকল।
চাচা-হ্যালো, বাবা। কেমন আছিস তোরা?
দিব্য-ভালো আছি বাবা। সুখবর হলো এবার তোমার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। ভিসা পেয়ে গেলাম বলে। আবার আমরা একসাথে থাকবো বাবা।
চাচা-বেশ ভালো, বেশ ভালো। আমার একাকীত্বের দিনক্ষণ এবার তবে ফুরোচ্ছে। শোন, তুই এসে নিয়ে যাবি না আমায়? আমি কিন্তু ভিসা টিসা কিছু বুঝি না। একা যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
দিব্য-চিন্তা করো না বাবা। আমি সব বুঝিয়ে দেবো।
চাচা-আচ্ছা ঠিক আছে।
মাঝি-ওপাড় যাবেন নাকি চাচা?
রফিক চাচা বাজারের তালিকা মাঝিকে দিয়ে বললেন,
চাচা-না, শোন, রাতে ফেরার পথে এগুলো নিয়ে আসবি মনে করে।
মাঝি-জ্বি, চাচা।
বিকেলে ঘড়ে ফিরলেন চাচা। ঘাটে বসে থাকতে ভালো লাগে রফিক চাচার। খটখটে রোদ পোহান তিনি। ভালোবাসেন রোদকে। কিন্তু তার শরীর মেনে নিতে পারেনা। তাইতো ফের বাসা বাধে নতুন কোন অসুস্থতা। সবাই ভাবে বয়সের দোষ। তখন রফিক চাচা মিটিমিটি হাসেন।
বিকেলে ফিরে শুনলেন নুড়ি এসেছিলো। সাথে আরও কতক বাচ্চা ছিলো। শুনে খুশি হলেন। নুড়ি মেয়েটা অতটা পাগল না। কিন্তু সুস্থও না। ওর প্রতি মায়া হয় রফিক চাচার। জন্ম থেকেই কষ্ট মেয়েটার।
ক্ষণিক বাদেই দুলু, আরাফাত, রাজু, নীতুর দল ঢুকে পরলো। বায়স্কোপ দেখার সময় হয়ে গিয়েছে।
"শোন শোন শোন সবাই মজার কাহিনী
যার কথা আজ বলছি তখন ছ'বছরের তিনি
মুরগী বাইরে খাচায় তিনি, মায়ের মনে ভয়
ভাবতে থাকেন ছেলের কিছু হয়েছে নিশ্চয়
দেখতে থাকেন একই দৃশ্য প্রতিদিন ধরে
জিগ্যেস করলেন ছেলেকে তার ওখানে কি করে?
উত্তরে ছেলে বলে মা, দেখছি ভীষণ করে
ডিম থেকে কি করে তাদের ছানাতে যায় ভরে।
আরে মহা এক বিজ্ঞানী সে, এডিসন তার নাম
বাতি আবিষ্কারের পরেই বিশ্বে যে তার দাম।"
ছোট বড় সকলেই তার বায়স্কোপ দেখতে আসে। কিন্তু এ সময়টা তিনি বড়দের দেখতে দেন না। বিশেষ করে মনজু আর করিম শেখ এর উৎপাতে তিনি দিশেহারা হয়ে যান মাঝে মাঝে। বিয়ে তাদের দুজনেরই হয়েছে। করিম শেখের মেয়ে আছে একটা। সেও নীতুর সাথে বায়োস্কোপ দেখতে আসে। এটা নিয়ে ছোটদের সমাজে এক বিশেষ রসিকতা সর্বদা বিরাজ করে। কিন্তু মনজু আর করিম শেখের ছেলেমানুষি মনে কখনই তা আচড় কেটে উঠতে পারে না।
রফিক চাচা এসব কান্ড-কারখানা দেখেন আর মিটিমিটি হাসেন।
অবসর প্রাপ্তির পর থেকেই তিনি এই বায়োস্কোপের চল শুরু করেন। প্রতিটি রীলেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনাংশ খন্ডিত থাকে। তিনি বিশ্বাস করেন এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, আলোর দিকে হাটতে থাকলে আধার পেছনে পড়ে যায়। তিনি চান সবাই আলোর দিকে হাটুক। তার ছেলের মত আলোকিত হোক। তার ছেলে দিব্য। বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য গিয়েছে। যাওয়া হয়েছে কিন্তু পারিপার্শ্বিকের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে আর ফেরা হয়নি। নানা কারণে সময়ে সময়ে বেশ দ্বায়িত্ব নিয়ে ঠিক আটকে দিয়েছে পরিস্থিতি। রফিক চাচার এতে দু:খ নেই, সুখ আছে।
ছেলের আবদারে তিনি ছেলের সাথে থাকতে সম্মতি জানিয়েছেন নির্দিধায়। সকালে পাকা কথা হয়েছে দিব্য এর সাথে।
দিব্যঃ হ্যালো বাবা।
বাবাঃ হ্যা, কবে আসছিস?
দিব্যঃ আসতে পারছি না বাবা। প্লিজ কিছু মনে করো না। আমার এক বন্ধু তোমাকে নিয়ে আসবে। একদম চিন্তা করো না বাবা। ওকে তুমি চেন বাবা। মনে আছে আজিজকে? একইসাথে পড়তাম স্কুলে।
চাচাঃ হ্যা, বেশ মনে আছে।
দিব্যঃ আজই যাবে সে তোমার কাছে। চিন্তা করো না বাবা ও তোমাকে ঠিক নিয়ে আসবে।
চাচাঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
রফিক চাচা মাঝিকে বলে দিলেন ভালো কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করতে। আজিজ আসবে।
পথিমধ্যে নুড়ি জানতে পারলো যে, রফিক চাচা চলে যাবেন। ছুটটে এলো,
নুড়িঃ দাদা তুই কোথায় যাবি রে?
চাচাঃ দিব্য এর কাছে যাচ্ছি রে। তুই যাবি আমার সাথে?
নুড়িঃ ইইহ। কখখনো না। তোকেও যেতে দেবো না।
চাচাঃ হাহাহা। কোথায় কোথায় ঘুরলি সারাদিন? খেয়েছিস কিছু? আজ আমার সাথে থাক। যাসনে।
বিকেলের দিকে আজিজ এলো। চা খেতে খেতে সবটা বললো।
চাচাঃ আজিজ, তাহলে আমরা যাচ্ছি কবে?
আজিজঃ কাল বাদে পরশু চাচা। পরশু সকালে ফ্লাইট।
এমতাবস্থায় বায়স্কোপের ক্ষুদেভক্তরা এসে পরলো।
আজিজঃ এরা কারা চাচা?
চাচাঃ এরা হলো আমার বায়স্কোপের দর্শক।
আজিজঃ ঠিক বুঝতে পারলাম না চাচা।
চাচাঃ বুঝতে হবে না। দেখে যাও।
মাঝি বায়স্কোপ নিয়ে এলো।
"আয়, আয়, এক যে ছিলো......"
আজিজ মুগ্ধ হয়ে দেখছে, শুনছে। নুড়ি চুপচাপ বসে রয়েছে। বয়ান শেষে করিম শেখের মেয়ে প্রশ্ন করলো,
ঃ দাদু, তুমি চলে যাবে?
চাচাঃ হ্যা, দাদু।
ঃ আর বায়স্কোপ দেখাবে না?
চাচাঃ অবশ্যই দেখাবো। তোমার মাঝি কাকা দেখাবে।
মাঝিঃ চাচা আমি?
চাচাঃ হ্যা, পারবি না?
মাঝি মাথা নিচু করে রয়েছে।
চাচাঃ তুই পারবি। আমার বিশ্বাস আছে। রোজ ওদের বায়স্কোপ দেখাবি। নতুন রীল করবি। তুই পারবি।
সবাই চলে গেলো। মাঝি রফিক চাচার ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো। নুড়ি একইভাবে বসে রইলো। চুপচাপ দেখতে লাগলো সব।
পরদিন সকালে রফিক চাচা ঘাটে গেলেন। ভাবলেন, চলে গেলে তো আর এখানটায় বসা হবে না। আজ মাঝি নেই। গোছগাছ করতে ব্যস্ত। থাকলে নদীতে একটু ঘোরা যেত। একবার ভাবলেন নিজেই বৈঠা বাইবেন। কিন্তু শরীর ও মনের জোড় আর আগের মতো নেই। কিছুক্ষণ বসে থেকে গেলেন রাবেয়ার কবর জিয়ারত করতে। ১৪ বছর হতে চললো রাবেয়া চলে যাওয়ার। মাঝি নিয়মিত কবর পরিষ্কার করে রাখে। পথেঘাটে হাটছেন আজ। যতই হাটছেন ততই মনোভার হয়ে আসছে। কষ্ট হচ্ছে। তিনি ভাবতেন দিব্য হয়তো মায়ায় পড়ে গিয়েছে। তাই দেশে ফিরছে না। কিন্তু এখন অনুভব করছেন মায়া তাকেও ঘিরে ফেলেছে। দুপুরের দিকে ঘরে ফিরলেন। দেখেন অনেকেই বসে রয়েছে তার জন্য।
নরেন্দ্র দাঃ দাদা আপনার বৌদি কিছু পিঠে পাঠিয়েছে। একবার খুব প্রশংসা করেছিলেন ওর বানানো পিঠের, মনে আছে?
চাচাঃ দাদা, সেকি ভুলবার মত?
আশেপাশে কোথাও নুড়িকে দেখা গেলো না।
মনজু আর করিম শেখ কোথা থেকে যেন ছুটে এলো।
মনজুঃ চাচা, আপনি নাকি চলে যাবেন? কোথায় যাবেন? কেনই বা যাবেন?
চাচাঃ দিব্য এর কাছে যাবো রে।
করিম শেখঃ চাচা, আমার তো দাবা খেলা শেখা হলো না।
করিম শেখ বাচ্চাদের মত কাদতে লাগলো। তাই দেখে উপস্থিত সবার চোখে জল এসে গেল।
রফিক চাচা কিছু বলার মত অবস্থায় নেই।নানাজন নানাভাবে মায়ার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেসবের মুখে রফিক চাচা বড় অসহায়।
কিছুক্ষণ পর আজিজ এলো। বাড়ির সবার অবস্থা দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
পরদিন সকাল সকাল রওনা হলো তারা। মাঝি সব জিনিসপত্র গুছিয়ে সামনে সামনে চলছে। বড় রাস্তা থেকে গাড়িতে গেলো স্টেশনে। হঠাত কোথা থেকে নুড়ি মেয়ের এসে হাজির,
নুড়িঃ দাদা তুই সত্যি সত্যি চলে যাবি?
চাচাঃ নুড়ি তুই এখানে?
নুড়িঃ দাদা তুই আর আসবিনা?
রফিক চাচা এবার আর জল ধরে রাখতে পারলো না। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললো,
চাচাঃ আজিজ, আমি যাবোনা। তুমি যাও।
চাচাঃ মাঝি, চল বাড়ি চল।
দিব্য ফোন করলো,
দিব্যঃ হ্যালো বাবা। আসছো তো?
চাচাঃ না বাবা, আমি এখানেই থাকবো। তুই ছুটি পেলে আসিস।
No comments